শীতকাল ক্যাম্পিংয়ের জন্য সবচেয়ে আদর্শ সময়। নতুন বছরের প্রথম পূর্ণিমা, প্ল্যান হলো শহরের বাইরে ঢাকা থেকে একটু দুরে কোন এক নদীর পাশে বছরের প্রথম ক্যাম্পিংটা করার। আলোচনা করে ঠিক হলো এশিয়ার ৬ষ্ঠ দীর্ঘতম নদ ব্রহ্মপুত্রের পাশে গড়ে উঠা বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম শহর- ময়মনসিংহ।
ইদানীং ঠাণ্ডাটা একটু বেশীই পড়ছে, শুনলাম ময়মনসিংহেও বেশ ঠাণ্ডা। সেই সব মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম, ব্যাগ গুছানো শেষ- ক্যামেরা, ব্যাটারী, পাওয়ারব্যাঙ্ক, টেন্ট লাইট, ম্যাট, স্লিপিং ব্যাগ, এয়ার পিলো, টেন্ট সব রেডি। হাইওয়েতে মটরসাইকেলে যাত্রা, যথাযথ সেফটি গার্ড আর ফুল ফেইস হেলমেট তো অত্যাবশ্যকীয়।
সকাল সকাল রওনা হয়ে যাই ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে, ৬টি বাইকে আমরা ৮ জন- আমি, সবুুজ ভাই, বাপ্পি ভাই, জুনায়েদ ভাই, ফারহানা ভিউ আপু, টিপু ভাই, অভিজিত দাদা আর রিয়াদ ভাই। আগের দিন বাসে জুয়েল ভাই আর রাজন ভাই চলে গিয়েছিলেন সুবিধা মত জয়গা বাছাই থেকে সব কিছু ঠিক ঠাক করতে।
যাওয়ার পথে ধান গবেষণাতে সূর্যমুখী বাগান দেখতে ভুলিনি, সাথে সরিষা ক্ষেত বোনাস ছিল। বিরি থেকে বের হয়ে ঘন্টা খানিক যাওয়ার পর পথে পুষ্পদাম রিসোর্টের বিরতি। ইতিমধ্যে প্রায় দুপুর হয়ে আসে, বিফ খিচুড়ি দিয়ে খাওয়া দাওয়াটা এখানে বেশ ভালোই জমলো। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর আবার যাত্রা শুরু। কিন্তু আমাদের তো আর কোন তাড়া নেই, ঘন্টা খানেক পর রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে আবার বিরতি, চায়ের সাথে চলল আড্ডা। এভাবেই ল্যাটাইতে ল্যাটাইতে একসময় পোঁছে গেলাম ময়মনসিংহ।
ব্রহ্মপুত্র নদের অদূরে ময়মনসিংহ শহরটা অনেক পুরাতন, ১৭৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত শহর, চারিদিকে প্রত্নতাত্ত্বিক বাড়িঘরে ছড়াছড়ি। কিন্তু খুবই হতাশ হলাম দেখে যে এর কোনটিই সংরক্ষণ করা হচ্ছে না, অযত্ন অবহেলার ছাপ। খুব বেশী দিন নেই যে এসবের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। একমাত্র শশী লজটাই সরকারি ভাবে রক্ষনাবেক্ষেন করে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। যদিও বেশ ক’বছর আগেও এটাকে মহিলা টিচার্স ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।
প্রথমেই চলে গেলাম আমরা সেই শশী লজ দেখতে। এবার একটু ইতিহাস ঘাটার পালা, মুক্তাগাছা জমিদার বংশের উত্তরসূরী মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে ৯ একর ভূমির ওপর একটি অসাধারণ দ্বিতল ভবন নির্মাণ করলেন। নিঃসন্তান জমিদার সূর্যকান্ত দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে এই ভবনের নাম রাখেন শশী লজ। বিখ্যাত এই ভবনটি ১৮৯৭ সালের ১২ জুন গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হলে ১৯০৫ সালে ঠিক একই স্থানে নতুনভাবে শশী লজ নির্মাণ করেন পরবর্তী জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী। শশীলজের মূল ফটকে রয়েছে ১৬টি গম্বুজ। মূল ভবনের সামনে রয়েছে বাগান। সেই বাগানের মাঝখানে আছে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা, যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সুদূর ইতালি থেকে আনানো গ্রিক দেবী ভেনাসের মর্মর মূর্তি। ১৮ টি বিশাল কক্ষের মূল ভবনের পেছনে আছে দোতলা স্নানঘর, পুকুর এবং মার্বেল পাথরের নির্মিত ঘাট। ভেতরে প্রায় প্রতিটি ঘরেই রয়েছে ছাদ থেকে ঝুলন্ত, প্রায় একই রকম দেখতে বেশ কয়েকটি ঝাড়বাতি। সাধারণ বাসভবন ছাড়াও বাড়িটিতে আছে নাচঘর, স্নানঘর। স্নানঘরে রয়েছে একটি সুড়ঙ্গ। ধারণা করা হয় এই সুড়ঙ্গপথে মুক্তাগাছা যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। মূল ভবনের পেছনভাগেও রয়েছে একটি স্নানঘর। পিছনের স্নানঘরটি দোতলা। পুকুরটির ঘাট মার্বেল পাথরে বাঁধানো।
১৯৫২ সাল থেকে শশী লজ ব্যবহৃত হয়েছে মহিলা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে। ২০১৫ সালে ৪ এপ্রিল জাদুঘর স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শশী লজটি অধিগ্রহণ করে।
শশী লজ থেকে আমরা চলে যাই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কে। ময়মনসিংহ জেলা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের পাশেই পার্কটি। পার্কের একপাশে একটি ভবনে রয়েছে জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা, বন্ধ থাকায় আমরা ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। পার্কের ঠিক অপর পাশে মানে ব্রহ্মপুত্র নদের অপারেই আমাদের ক্যাম্প সাইট। নৌকায় চেপে ব্রহ্মপুত্র পারি দিয়ে জুয়েল ভাই আমাদের সাথে যোগ দিলেন। বলতে ভুলে গিয়েছি এরই মধ্যে আরও একজন আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন, সোহেল ভাই। উনি ময়মনসিংহের স্থানীয়, টিপু ভাইয়ের পুরনো বন্ধু, একদম মাটির মানুষ। আপ্যায়ন করার জন্য অনেক পিড়াপীড়ি করেছিলেন, কিন্তু সময় স্বল্পতার কারনে আমাদের পক্ষে দাওয়াত গ্রহন করা সম্ভব হয়নি। জয়নুল আবেদিন পার্কের একপাশে ব্রহ্মপুত্রের কোল ঘেঁষে কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহাম্মেদের কিংবদন্তি চরিত্র “হিমু”থেকে অনুপ্রানিত হয়ে “হিমু আড্ডা” নামে সুন্দর একটি ক্যাফে আছে, সময় স্বল্পতার কারনে এখানেও বসা হয়নি।
পার্ক থেকে আমরা চলে যাই ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, পড়ন্ত বিকেলটা উপভোগ করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজের মধ্যে বসে সূর্যাস্ত উপভোগ করে বিখ্যাত জব্বারের মোড়ে গিয়ে আমরা নাস্তা করি। আমাদের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত একটা জায়গা থাকে, যেখানে বসে সবাই খাবারের সাথে চলে ভরপুর আড্ডা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা ঠিক তেমনি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জব্বারের মোড়। নাস্তার কথা থাকলেও টেবিলে বসার সাথে সাথেই সকলের পেটের ভেতর যেন ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। তাই হালকার বদলে হয়ে যায় ভারী খাবার। ভরপেট খেয়ে গরুর খাটি দুধের চা খেতে খেতে চলে আড্ডা।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে, আমরা ক্যাম্প সাইটের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ময়মনসিংহ পাওয়ার প্ল্যান্ট পার হয়ে সামনে এগিয়ে দেখি রাস্তা নেই। রাস্তার নামে এক হাটু বালির সমুদ্র, সেই পথে চলছে আবার ট্রাকের আনাগোনা। এদিক সেদিক ভুল রাস্তায় আসা যাওয়া করতে করতে কেটে যায় প্রায় ঘন্টা খানেক। অনেক সংগ্রামের পর পোঁছাই আমাদের ক্যাম্প সাইটে।
বছরের প্রথম পূর্ণিমা, আকাশে আজকের এই পূর্ণ চন্দ্রের নাম ইংরেজিতে দেখলাম Wolf Moon! মানে কি এই চন্দ্রে Wolf রা খুশিতে পার্টি করে? যাইহোক, টর্চের আলোয় আমাদের যার যার তাঁবু লাগানো শেষ। সূর্য ডোবার পর কুয়াশা অনেক দ্রুত পড়ছে, ৫ মিনিটে হেলমেট মোটরসাইকেল সব ভিজে গিয়েছে। জুয়েল ভাই কাঠ এনে ক্যাম্প ফায়ারের ব্যবস্থা করছেন। আর অন্যদিকে বরাবরের মত আমাদের ছবির যাদুকর জুনায়েদ ভাই মোবাইল দিয়ে দেখাচ্ছেন তার যাদু। ক্যাম্প ষ্টোভে চা পর্বের পর চললো সূপ নুডুলস পার্টি। খাওয়া দাওয়া শেষে ক্যাম্প ফায়ারের পাশে বসে অনেক রাত পর্যন্ত চলে আমাদের আড্ডা।
এবার ঘুমানোর পালা, যার যার তাঁবুতে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঢুকে পরি। ভোঁরে সূর্যদোয়ের সময় তাঁবু থেকে বের হই। কোন শব্দ নেই, শুধু ভোরের পাখির ডাক আর পাশে দিয়ে বয়ে চলা পৃথিবীর দীর্ঘতম নদনদীগুলির একটি ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি হিমালয় পর্বতমালার কৈলাস শৃঙ্গের নিকট জিমা ইয়ংজং হিমবাহে, যা তিব্বতের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। জাঙপো নামে তিব্বতে পুর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে এটি অরুণাচল প্রদেশে ভারতে প্রবেশ করে যখন এর নাম হয়ে যায় সিয়ং। তারপর আসামের উপর দিয়ে দিহাঙ নামে বয়ে যাবার সময় এতে দিবং এবং লোহিত নামে আরো দুটি বড় নদী যোগ দেয় এবং তখন সমতলে এসে চওড়া হয়ে এর নাম হয় ব্রহ্মপুত্র। পৃথিবীর দীর্ঘতম নদনদীগুলির মধ্যে ব্রহ্মপুত্র ১৫তম দীর্ঘ (২৮৫০ কিমি), ব্রহ্মপুত্র নদীর সর্বাধিক প্রস্থ ১০৪২৬ মিটার (বাহাদুরাবাদ)।
ধিরে ধিরে সকলের ঘুম ভাঙ্গে, জুয়েল ভাই চায়ের আয়োজন শুরু করেন। শীতের সকাল, নদীর পাশে বসে সূর্যের কোমল আলো গায়ে মেখে গরম চেয়ের মগে চুমুক দেওয়া, আর কি চাই।
রোদ উঠলে শিশিরে ভেজা তাঁবু শুকিয়ে সব গুছিয়ে নেই, এবার ঘরে ফেরার পালা। পথে সময় হলে মুক্তাগাছার মণ্ডা। আস্তে ধীরে আল্লাহ রহমতে সন্ধ্যা নাগাদ আমরা সকলে যার যার বাসায়।
ক্যাম্পিং এ গিয়ে পাখির গান শুনুন; সাউন্ড বক্স আর মাইক নিয়ে শোরগোল করে ক্যাম্পিং এর প্রশান্তি ঠাহর করা যাবে না।
প্রকৃতিকে পরিশুদ্ধ রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব তাই ভ্রমনে যেয়ে যেখানে সেখানে ময়লা ও অপচনশীল প্যাকেট (চিপসের প্যাকেট, বিস্কুটের প্যাকেট, পানির বোতল, পলিথিন, সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশ ইত্যাদি) ফেলা থেকে বিরত থাকুন।
ভ্রমণ হোক আনন্দময়, নিরাপদ, দায়িত্বশীল।