বর্ষাকাল আর ৪/৫ মাসের লকডাউনের ধাক্কা সামলে উঠতেই মন ছুটল বাইরের দিকে। সেপ্টেম্বরের তাপমাত্রা যদিও সহনীয় নয় তবুও সমুদ্র ডেকে নিল শরীরের চামড়া পোড়াতে। যেন শহীদাই ডাকছিল তার কাছে। হ্যা সেই শহীদা, The Island Lady। মিষ্টিমুখের দ্বীপবাসীনির টানে টানে একটা রহস্যময় যাত্রার পরিকল্পনা মনে মনে আকা হল, সেটার আংশিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাস করে দেওয়াতে জুটে গেল আরো ৫ জন রহস্যপ্রিয় দুরন্ত মানুষ। সাকিব, আকবর, সজীব, ইয়াশ, সাখাওয়াত আর হাবিব। এক বৃহস্পতিবার আলোকিত সন্ধায় আমরা আরামবাগ থেকে সেজুতি ট্রাভেলসের এসি বাসে আরামে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। আমি ছাড়া এর আগ অবধি গন্তব্য কেউ জানত না। বাকি ৫ জন কাউন্টারে এসে টের পেয়েছে তারা আসলে টেকনাফ যাচ্ছে।
বেশ হই হই করে, ঘুমিয়ে, খেয়ে ভোরবেলায় আমরা চলে আসলাম টেকনাফে। বাস থেকে নেমে সোজা আকবর ভাইয়ের এক এক্স কলিগের বাসায় প্যাকড হয়ে গেলাম। ওখানেই আমাদের প্রাতঃকর্ম ও প্রাতরাশ সারা হলো। এর ভেতর সেন্ট মার্টিন এর ট্রলারের খোজ নেওয়া গেল। ট্রলার ছাড়বে ১০ টায়। হ্যা আমরা যাচ্ছি শহীদার খোজে, প্রবাল দ্বীপে। দ্বীপকন্যা আমাদের ডাকছে। ১১ টার ২য় ট্রলারে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। এর আগে ঠাসাঠাসি করে প্রথম ট্রলার চলে গেছে, ২য় টা বেশ ফাকা। ট্রলারে ওঠার আগেই আকবর ভাই আর সজীবের মধ্যে সানব্লক নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি হয়ে গেল। সজীব আকবর ভাই এর সানব্লকে সাতার দিচ্ছিল তাই এই ঝগড়াঝাটির সুত্রপাত। রেগেমেগে সজীব আরেকটা সানব্লক কিনে নিয়ে এলো। ১১ টার ট্রলার যখন শাহপরীর দ্বীপের কাছাকাছি তখনি হয়ে গেল বিপত্তি। হঠাৎই ট্রলারের মনে হল “কিচ্ছু ভালো লাগছেনা, যাই একটু মিয়ানমার ঘুরে আসি”। সে তার ইঞ্জিন বিকল করে দিল। নাফ দরিয়ায় ভেসে আমরা চলেছি নাসাকা বাহিনীর বন্দুকের নলের দিকে। এসময় বাংলা সিনেমার নায়কের মত উদয় হলো আরেক মালবাহী ট্রলার। সে আমাদের ট্রলারকে কোনমতেই নাসাকা নামক ভিলেনের হাতে পড়তে দেবে না। সে নিজ দড়িতে টেনে আমাদের ট্রলার কে শাহপরীর জেটির কারাগারে লটকে দিল। ততক্ষনে আকবর বিবিসির কারনে সারা দুনিয়া জেনে গেছে ট্রলার বিকল হয়ে সাগরে দিশেহারা হয়ে ভাসছি আমরা। শাহ পরীর পুলিশ ফাড়ির এস আই মিজান সাহেব এসে আমাদের পানি আর বিস্কুট দিয়ে ঠান্ডা করলেন। নইলে ট্রলারের এক পর্যটক আপু রেগেমেগে হয়ত জেটির বিজিবি কে মাইর ই দিত।
এদিকে ট্রলারের মাঝি হাওয়া হয়ে গেছে, সে গেছে টেকনাফে ট্রলারের পার্টস আনতে। আর আমরা ৬০ দিশেহারা পর্যটক জেটির সাথে ভাসতেছি। প্রায় ৩ ঘন্টা পর আমাদের ভাসমান জীবনের সমাপ্তি হইল। ট্রলার ঠিক করে আমরা আবার রওয়ানা দিলাম। ততক্ষনে দুপুর হেলে পড়েছে। কিচ্ছুক্ষণ পর আমরা নাফ দরিয়া ছেড়ে বঙ্গোপসাগরে পড়লাম। দূরে যদিও সেন্ট মার্টিন দেখা যাচ্ছে তবুও মুখোমুখি হলাম বিরাট বিরাট ঢেউয়ের। রোলার কোস্টারের মত ঢেউয়ে দুলে দুলে সামুদ্রিক স্রোতের সাথে একপ্রকার লড়াই করে আমরা এগুচ্ছি সেন্ট মার্টিন এর দিকে। স্রোতের সাথে ছবি পিয়াসী অনেকে ছবি তুলতে গিয়ে ট্রলারের কিনারে বসেই সুইমিং করে নিল, যেমন আকবর ভাই। অবশেষে প্রায় ৬ ঘন্টার গুটি গুটি ট্রলারপায়ের জার্নি শেষে বিকাল নাগাদ আমরা সেন্ট মার্টিন এ এসে উপনীত হলাম। ট্রলার থেকে নামা মাত্রই ছুচো এসে যেন পেটে ঝাপ দিল। পেটে নাচানাচি করে জানাইয়া দিল- আগে খেয়ে নে বেটা।
শহীদার চাচা বদি আলমের দোকানে লট বহর, ভাজ করা সংসার ফেলে রেখে আমরা ছুটলাম খাদ্যের সন্ধানে। অফ সিজন হওয়ায় মাত্র দুইটা রেস্টুরেন্ট খোলা আছে। খুজেপেতে একটাতে রূপচাদা পাওয়া গেল। অর্ডার করা হল রূপচাদা ফ্রা, ভাত, ডাল, সব্জী, লবন, পানি, কাচামরিচ, ভাজা মরিচ আর পেয়াজ কাটার। একটু হাত মুখ ধুয়ে ৬ টা ডাইনোসর হামলে পড়ল রুপচাঁদা মাছ এর উপর। ১৫ মিনিট ধরে চেটেপুটে সব খেয়ে ফেলল। এবার শান্তি। আহ!এবার চা খেতে খেতে শুরু হল সংসার পাতার চিন্তা। তবে এদিনের আবহাওয়া ছিল বেশ বিরূপ।
তাছাড়া আগের রাতের বাস জার্নি আর সারাদিনের ট্রলার জার্নি শেষে সবাই অনেক ক্লান্ত। ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম আজ আর শহীদাদের বাসার দিকে ক্যাম্প করতে না যাই, আজ কোন রিসোর্টে ঘুম দিয়ে কাটাই। খুজে পেতে ৫০০ টাকায় একটা রুম নিলাম। রুমে এসে ব্যাগ রেখে সবাইই গোসল দিল। এরপর আমরা রিসোর্টের সামনে বিচে আড্ডা জমালাম। আকবর ভাই আর শাখাওয়াত ভাই লাইভ, ভিডিএ এসব শুরু করল। ইয়াশ শুরু করল ফটোগ্রাফি। আমি, সজীব আর হাবিব একটা নৌকার উপরে বসে গল্পে মেতে গেলাম। আগামী পর্বে- রহস্যময় ভ্রমণের রহস্য শুরু।
লেখকের ফেসবুক প্রোফাইল লিঙ্ক https://www.facebook.com/najmus.sabuj