আমার কোলের মেয়েটার নাম পিউ। সাদা গেঞ্জির ছেলেটা অমর, নিচের ছবিতে ছাগল কোলে দাঁড়ানো মেয়েটা শিউলী। বাবা অজিত পটনায়েক, মা শ্যামা পটনায়েক। এই পরিবারকে কেন্দ্র করে লেখাটা। বিকেলে পৌছে এখানে জঙ্গলের পাশে টেন্ট যখন পিচ করছিলাম, পিউর বড়বোন শিউলি তখন পিউকে বগলদাবা করে মাঠে ছাগল চড়াতে ব্যস্ত সাইটের পাশেই। এই অঞ্চলে এই জেলার কয়েকজন সাইক্লিস্টস/ফটোগ্রাফার ছাড়া কখনো কোনোদিন কোনো ট্যুরিস্ট/ট্রাভেলার থাকতে আসে নি, তাই এলাকার প্রতিটা মানুষ তখনো আমাদের ভয় পেয়ে দুরত্ব রেখে চলছিলো। খুব ই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো বলা যায়। ভয় পাওয়াটা যদিও স্বাভাবিক ই, বর্ডার একেবারেই পাশে। মোটামুটি সবাই জানে ওপাড় থেকে নানান মাদক এই পথ দিয়েই এদেশে ঢোকে!
টেন্ট পিচিং শেষে আমরা ক্লান্ত হয়ে বসা তখন। বেশ ধকল গেসে সারাদিনে। না খাওয়া না ঘুম। শিউলির নাম তখনো জানি না। পাশেই ছাগল চড়াচ্ছিলো তখনো। ডাক দিয়ে বললাম বোন এদিকে চাপকল কোনদিকে পাবো একটু বলবে? শোনামাত্র সে ছাগল রেখেই কোলে বোনকে শক্ত করে জাপটে ধরে একছুটে টিলার উপরে উঠে গেলো। স্বাভাবিক এটাই,অচেনা অজানা তিনটা ছেলে জঙ্গলের পাশে বসে ডাকছে, ঘোরতর ব্যপার ই বটে। আমিও ওদিকে মনযোগ না দিয়ে চুলা খোলায় দৃষ্টি দিলাম। কিন্তু মিনিট দু’য়েকের মাঝেই মাঝবয়সী এক হিন্দু মহিলা মাথায় ঘোমটা টেনে টিলা দিয়ে নেমে এলো। বুঝতে বাকি রইলো না উনি ই মেয়েটার মা।নেমে আসা হতে উনি আমাদের বারবার বাবু সম্বোধন করে কথা বলছিলো। মূলত উনারা ম্যানেজার সহ চা বাগানের কর্মকর্তাদের বাবু সম্বোধন করেন, আমাদের এখানে থাকার পারমিশন পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে বলা যায়, তো ওই সূত্রে ম্যানেজারের সাথেও দেখা করতে হয়েছে, তার রেশ ধরেই এই ‘বাবু’ সম্বোধন।
আমি বারবার তাকে মা বলে সম্বোধন করে বলছিলাম,”মা আমরা আপনার ছেলের বয়সী, আমাদের বাবু বলবেন না, আমরা কোম্পানীর কেউ নই”। খানিকখন কথা বলার পরেই মহিলা সহজ হয়ে এলো আমাদের সাথে।খুব ই হেল্পফুল মহিলা,তার সাথে তার পরিবারের সবাই ই!ওদের বাড়ি আমাদের ক্যাম্পসাইটের পাশের টিলাটার উপরেই।উনি ই নিজেই তার মেয়েকে ডাক দিয়ে আমাদের বোতল গুলো উপরে নিয়ে খাবার জল এনে দিতে বললো।এরপর থেকে বেশীরভাগ টা সময় শিউলী ই আমাদের খাবার জল বয়ে এনে দিয়ে গিয়েছে সাইটে।সময়ের সাথে সাথে পরিবারটার সাথে সম্পর্ক এতটাই ভাল হয়ে গেলো যে কাজে আকাজে তাদের ঘরে যেয়েই আমরা বসে থাকতাম, আড্ডা দিতাম তার স্বামী,ছেলের সাথে।
সেদিন রাতে তার ছেলেকে ডেকে আমাদের ক্যাম্পসাইটে রান্না করা খিচুড়ি ও খাইয়েছিলাম।ওদের বাড়ি বলতে একটামাত্র রুমের মাটির ঘর। দুই কোনায় দু’টো বড় খাট,রান্নার ব্যবস্থা উঠোনেই বাশের বেড়া দিয়ে।ঘরে আত্বীয় স্বজন নিয়ে মানুষের সংখ্যা ১১ জন! এই একটুখানি মাটির ঘরে এগারোজনের বসবাস! বড় ছেলের বয়স আমার থেকে একটু কম হতে পারে। এই ২২-২৩ মত। উঠোনের এক কোনায় নিজের জন্য বাশ দিয়ে একটা মাচাং মত বানিয়ে নিয়েছে সে। গরমে সে আর বোন ওখানেই ঘুমায়। অলস দুপুরে ওই টিলার মাথার খাটেই পা দুলিয়ে বসে আয়েশ করে আড্ডা দিতাম আমরা।দেখা যেত ওখানেই আমাদের সাথে কথা বলতে উঠোনে পাড়ার নানান বয়সী লোকজন জড়ো হয়ে যেত।এই যা,অন্য কথায় চলে গেলাম।ওদের টয়লেট বলতে তিনটে গাছে ছালার বেড়া দেওয়া,মাঝে একটা ছোট প্যান। এই ই।গোসলখানাও এমন ধরনের ই।খালি নিচে একটু শক্ত মাটির প্রলেপ।পুরো ঊঠোনে গরুর গোবর পানি আর মাটির মিশ্রিত প্রলেপ।
এক কোনায় ছোট একটা তুলশী গাছের পাশেই মাটির একটু উচু প্রলেপের গড়া ছোট প্রার্থনার স্থান। এখানে পানির কস্ট বড় কস্ট।যারা একটু স্বচ্ছল,তারা নিজস্ব চাপকল বসিয়েছে,যাদের সেই সামর্থ্যে কুলায়নি তারা কিলোমিটার দুই হেটে মন্দিরের চাপকল থেকে পানি বয়ে নিয়ে আসে।ওরাও তাই ই।পানি বয়ে নিয়ে এসে উঠোনের কোনায় বড় একটা কন্টিনারে জমা করে রাখে। ও দিয়েই গোসল,ধোয়ামোছা, রান্নাবান্না, খাওয়া চলে।শিউলির মা চা বাগানে কাজ করে দৈনিক ১০৪ টাকা বেতনে।বাবা অজিত পটনায়েক করেন পান তোলার কাজ। পান তুলতে সে দিনে ৯ কিলোমিটার হেটে একটা পুঞ্জীতে যায়,সেখানে গাছে উঠে পান তুলতে হয় সারাদিন।বেশ রিস্কের কাজ। তাই টাকাও একটু বেশী। দিনে ৩০০ টাকা। সাথে মোটমাট ১৮-১৯ কিলোমিটার হাটা আর অসংখ্য গাছে ওঠা ত আছেই!তাদের একমাত্র বড় ছেলেটা যদিও বেশ ভালই বখে গিয়েছে বোঝা যাচ্ছিলো।কাজ বাজ তেমন কিছু করে না,এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করেই তার দিন কাটে। বরং সেদিন রাতে ক্যাম্পসাইটে যখন এসেছিলো কথাবার্তা বেশ অসংলগ্ন ছিলো,সাথে শরীরে এলকোহলের তীব্র গন্ধ ত আছেই।বর্ডারের সাথে সহজে সম্পর্কের কারনেই হয়ত এই পরিনতি।পিউ আর শিউলী!
পিউর বয়স আর কতই বা হবে,আড়াই বড়জোর। শিউলীর বয়স ১৫ মত হবে।এই পাড়ায় ১৫ অনেক বয়স।আসার সময় কি বলে আশীর্বাদ করব বুঝতে পারছিলাম না ঠিক, ওর মা ই বলে দিলো,বোন বলে ডেকেছি যেহেতু, আশীর্বাদ করতে যেনো ভাল একটা বর পায়,সামনের দূর্গাপূজায় তার বিয়ে। কথা চলছে সামনের পাড়ার এক বাড়ির সাথে।আশীর্বাদ খালি হাতে করা যায় না।আমাদের সাথে দেওয়ার মত তেমন কিছু ছিলো না বলা যায়। মুনাবিরের কফির বোতল টা শিউলীকে আর বাকি থাকা স্যুপ আর নুডুলসের প্যাকেটগুলো পিউর হাতে দিয়ে এসেছি।আর তাদের বড়ভাই আমার প্রায় শুন্য গ্যাস ক্যানটার দিকে তাকিয়ে ছিলো দেখে ওটাই তাকে দিয়ে এসেছি,জানিনা ওটা দিয়ে সে ঠিক কি কাজ করবে।কতটা সরল মন সবার।হয়ত কোনোদিন আর দেখাও হবে না এই মানুষগুলোর সাথে।কিন্তু পরিবারের সাথে মিশে যাওয়ার সেই অন্তঙ্গতাটা হয়ত আজীবন অনুভব করে যাবো।কোনো স্বার্থ নেই,কোনো কারন নেই,শুধুই মানুষের প্রতি মানুষের আবেগটুকুর কারনেই এই ভালবাসা!