You are currently viewing ভবঘুরে ভ্রমণঃ একা একা পঞ্চগড়।

ভবঘুরে ভ্রমণঃ একা একা পঞ্চগড়।

আকবরিয়া হোটেলের দই খেয়ে সাত মাথা মোড়ের দিকে যখন হেটে হেটে যাচ্ছি আস্তে আস্তে নীরব হচ্ছে পরিবেশ। উত্তরের রাজধানী খ্যাত ব্যাস্ত শহর বগুড়ার রাস্তার দুইপাশের দোকানগুলো একটা একটা বন্ধ হচ্ছে আমি ধীর পায়ে সামনে আগাচ্ছি। কিছু ওষুধের দোকান ছাড়া অন্যসব দোকান ই বন্ধ হয়ে গেছে বলা যায়। ঘড়িতে সময় রাত ১২ টা ছুই ছুই। মধ্যরাতে একা একা বগুড়ার রাস্তায় হাটছি আর চিন্তিত মনে একটা কথাই ভাবছি পারবো তো বাসে উঠতে? এতো চিন্তার কারণ রাতেই যাবো হিমালয়কন্যা খ্যাত পঞ্চগড়ে, দেশের সর্ব উত্তরের এই জেলায় যাচ্ছি প্রথমবার। সেটাও কিনা বগুড়া থেকে।

এখান থেকেই দেখা মিলে কাঞ্চনজঙ্গার।

দিন দুয়েক আগে বগুড়া এসেছিলাম, আনাচকানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি বয়সে অর্ধশত ছুই ছুই এক তরুন সেবাস্তিন দাদার সাথে। তিনি রাতে খুলনা চলে যাচ্ছেন আমার গন্তব্য সমতলের চায়ের দেশ পঞ্চগড়। বগুড়া থেকে রাতে পঞ্চগড় যাওয়ার কোনো বাস সার্ভিস নেই। সন্ধ্যেবেলা এসে কাউন্টারে কাউন্টারে খোজ করেছিলাম কিন্তু উপায় মেলেনি। এক কাউন্টারের ভদ্রলোক সমাধান বাতলে দিলেন, ঢাকা থেকে পঞ্চগড় গামী বাসগুলো মধ্যরাতে বগুড়ার সাত মাথা ক্রস করে যায়, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মিলতে পারে তাতে উঠার সুযোগ। সেই আশায় দাদাকে খুলনার বিআরটিসির চকচকে এসি বাসে তুলে দিয়ে আমি হাত তুলে থামিয়ে টিকেট বিহীন উঠার জন্য মধ্যরাতে রাস্তায় হাটছি।বগুড়া থেকে ঢাকায় আসার বাসগুলোতে মধ্যরাতে প্রচুর যাত্রী। আর সাত মাথা, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এই রাতদুপুরে।

চারদিকে হাক ডাক, রাতের নিস্তব্ধতা সেই কবেই উড়ে গিয়েছে। আশেপাশে রাস্তায় অসংখ্য দোকানপাট, বিশেষ করে হরেকরকম খাবারের দোকান। কেউ পিঠা বিক্রি করছে কেউ ঝালমুড়ি কেউবা তেলেভাজা। এরকম অচেনা জায়গায় রাত্তিরেও কেমন একটা জিজ্ঞাসু চাহনী নিয়ে চারদিকে দেখছিলাম। একবারের জন্যও অনিরাপদ বোধ হয়নি। রাস্তার মাঝখানে সারি সারি ভ্যান নিয়ে কিছুক্ষন আগেই এসে দাঁড়িয়ে গেলো আরো কয়েকটা কাচে ঘেরা খাবারের দোকান। এরমধ্যেই কানে হেডফোন গুজে টিওবির সেইন্ট মার্টিন পরিচ্ছন্নতা অভিযান নিয়ে নিয়াজ মোর্শেদ, তানভীর মৃদুল আর মুনীম চৌধুরীর আড্ডা গল্প শুনছিলাম রেডিও থেকে।ঢাকাগামী অসংখ্য যাত্রীর সাথে এক বাস কাউন্টারে ফ্যানের নিচে বসে আছে আর চোখ তাক করে রেখেছি ঢাকা থেকে আসা বাসের দিকে। একটা একটা বাস আসে আর জিজ্ঞাসু চাহনি নিয়ে এগিয়ে যাই। কয়েকটা বাস যাওয়ার পরে হানিফের এক বাস এলো সামনে লেখা বাংলাবান্ধা।

তেতুলিয়া ডাক বাংলো।

মনে হলো বাংলা ছায়াছবির নায়ক জসীমের মতো লটারি পেয়ে গেছি। হাত তোলার আগেই বাস দাড়িয়ে গেলো, বুঝলাম এটা তাদের নিয়মিত কার্যক্রম। কঠোর দরদাম করে ৩০০ টাকায় উঠে গেলাম পঞ্চগড়ের বাসে। উত্তরাঞ্চলের বাসগুলোর অবস্থা অন্যান্য অঞ্চল থেকে কিছুটা অবহেলিত থাকে সবসময়ই দেখেছি। সেই ধারাবাহিকতা রক্ষায় বাসের সিটে ক্যাচক্যাচে শব্দ আর সামনের সিটে হাটু আটকে যাওয়া নিয়েই পিছনের সিটে বসে একটা ঘুম দিয়ে ফেললাম। ঘুম ভাঙ্গলো সুপারভাইজার এর ভাড়া চাওয়ার তাগাদায়। কিছুক্ষণ পরে সামনের দিকে একটা সিট মিললো। ভোর চারটার কাছাকাছি সময়ে পঞ্চগড় পৌঁছে গেলো বাস, আরো কিছু সময় পরে তেতুলিয়া।

যারা বাংলাবান্ধা যাবে তাদেরকে অন্য এক বাসে তুলে দেওয়া হলো আমি তেতুলিয়া তে থেকে গেলাম। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে সামনে হেটে গেলাম, মোড়ের মসজিদে ফজরের নামাজের জন্য রেডি হচ্ছে মুসল্লীরা আমিও সামিল হলাম। নামাজ শেষে ম্যাপ দেখে হাটা শুরু করলাম ডাকবাংলোর দিকে। এরমধ্যে রাস্তায় নেমে গেছে কয়েকজন সাইকেল নিয়ে, হয়তো কোনো কাজে যাচ্ছে। ডাকবাংলোয় উঠার পথে দেখা হলো এক ষাটোর্ধ চাচার সাথে। তার সাথে কথা বলে জানলাম প্রতিদিন ভোরেই আসেন হাটাহাটি করতে। প্রায়ই দেখা যায় স্লিপিং বুদ্ধাকে। চাচার সাথে গল্প করতে করতে ডাকবাংলো এলাকা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ছড়ানো ছিটানো চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট দেখে মনে হলো প্রতিদিন অনেক লোকের আগমন ঘটে, যদিও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আবর্জনা না ফেলার জন্য সুন্দর সুন্দর বার্তা সংবলিত পোষ্টার লাগানো আছে।

রাতের আলো নিভেনি তখনো।

সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত এখানেই রইলাম, অন্ধকার কেটে গিয়ে আকাশ পরিষ্কার হওয়ার সাথে সাথেই উত্তর পশ্চিম কোণে হাল্কা একটা রেখে ভেসে উঠলো। কিছুক্ষন পরে আরো কয়েকজন প্রাতঃভ্রমণকারী আসলেন, উচ্ছাসের সাথে আঙ্গুল প্রদর্শন করে আমাকে দেখালেন ওই যে “কাঞ্চনজঙ্ঘা”৷ তারা জানালেন প্রতিবছর অনেক লোক আসে ঢাকা থেকে, তবে এবার আমাকেই প্রথম দেখেছেন। প্রায় সাতটা পর্যন্ত এখানেই রইলাম, মুগ্ধ হয়ে দেখলাম স্লিপিং বুদ্ধের আবছায়া অবয়ব। মোবাইলের ক্যামেরায় খুব একটা ধরা যায়নি, চর্মচক্ষু যা উপভোগ করেছে তাতে মন বেশ প্রসন্ন হয়েছে। তারপর বেরিয়ে গেলাম বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট এর উদ্দেশ্যে। ডাকবাংলো থেকে বেড়িয়েই একটা ভ্যান পেয়ে উঠে গেলাম, কিছুদূর গিয়ে জানলাম তারা আর যাবেনা।

শুষ্ক মহানন্দা।

নেমে গিয়ে মহা নন্দা নদীর পাশ দিয়ে সীমান্তবর্তী সড়ক ধরে হেটে হেটে গেলাম কিছুক্ষন। একটা অটো এসে জিজ্ঞেস করাতে বাংলাবান্ধা বলাতে তুলে নিলো। রাস্তাটা সীমান্তের পাশ দিয়েই মহা নন্দার সাথে পাল্লা দিয়ে বয়ে গেছে। যদিও মহা নন্দা এখনি মৃত প্রায়, পানি শুকিয়ে বালুচরে পরিনত হয়েছে। সকাল ৮ টায় শুরু হয় পোর্টের কার্যক্রম, এর আগেই পৌছে গেছি আমি। বিজিবি চেকপোস্টের সামনে গিয়ে সাইনবোর্ড দেখে হতাশ হলাম। বিকাল ৪ঃ৩০ থেকে ৫ঃ৩০ পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য খোলা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। কয়েক মিটার দূরেই ওপারে বিদেশ, বি এস এফ সদস্যরা প্যারেড করছেন লেফট রাইট। এরমধ্যেই একটা গাড়ি এসে থামলো বিজিবির লোকবল নিয়ে, কেনো এসেছি জানতে চাইলেন সিনিয়র। পেশাগত পরিচয় দিয়ে আগমনের কারন জানানোর পরে জিরো পয়েন্ট যাওয়ার অনুমতি দিলেন।

ঢাকা কতোদূর?

জিরো পয়েন্ট গিয়ে খুব ভালো লাগলো, এই জিরো পয়েন্ট অনেকের জন্য মাইলফলক। অনেক খ্যাতিমান লোক সাইক্লিং, রানিং, হাটা কর্মসূচির সূচনা বা সমাপ্তি এখানে করেছেন। কিছুক্ষন দাড়ালাম, ছবি তুললাম। যেহেতু একাই এসেছি তাই নিজের ছবি তোলার মতো কাউকে পেলাম না, পিছনে তাকিয়ে দেখি বিজিবির দুই সদস্যা এসেছেন আমাকে পাহাড়া দিতে। তাদেরকেই অনুরোধ করলাম ছবি তুলে দিতে, একজন মোবাইল নিয়ে ক্লিক করতেই সিনিয়রের হাক এলো। তারপর চলে এলাম আবার তেতুলিয়া। এবার নাস্তা করে নিয়ে পাশেই একটা মন্দির ঘুরে এলাম, ততোক্ষণে স্কুলগামীদের দ্বিচক্রযান রাস্তার দখল নিয়েছে। উত্তরের পথে ঘাটে যতোটা প্রমীলাদের সাইকেল চড়তে দেখা যায় তা সারাদেশে অনুপস্থিত।

শিব মন্দির, তেতুলিয়া।

কাজী এন্ড কাজীর চা বাগান দেখতে রওশনপুর বাজারের লোকাল মাহিন্দ্রায় চেপে বসলাম। রওশনপুর বাজার থেকে ভ্যানে গেলাম সমতলের চা বাগানে। সিলেট, চট্টগ্রামের চা বাগান দেখলেও উত্তরে গড়ে উঠা সমতলের এই চা বাগান বেশ ভালো লাগলো। আনন্দধারা রিসোর্টে প্রবেশ করতে চাইলে অনুমতি নিতে হয় কর্তৃপক্ষ থেকে। জুবায়ের আবদুল্লাহ ভাইয়ের কাছ থেকে ম্যানেজার সাহেবের ফোন নাম্বার নিয়ে কথা বলে অনুমতি নিলাম। সুনসান নীরব একটা জায়গা, সাজানো-গোছানো বাগান। এরমধ্যে কয়েকটি সুন্দর বাগানবাড়ির মতো গোল ভবন। একটা থেকে আরেকটাতে যাওয়ার জন্য সুন্দর কংক্রিটের সেতু, নীচ দিয়ে বয়ে গেছে চপলা তরুনীর মতো এক নদী। কয়েকটি ঘোড়া মনের সুখে ঘাস চিবোচ্ছে। রোদের প্রাচুর্যতা বাড়ছে, শরীরে ভর করেছে ক্লান্তি তাই ফিরে যেতে হবে আয়েশের খোজে। বের হয়ে এবার মহারাজার দীঘির উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। পঞ্চগড় গামী বাসে উঠে নামলাম বোর্ডবাজার সেখানে থেকে অটোরিকশায় গেলাম মহারাজার দীঘি।

আনন্দ ধারা রিসোর্ট।

গাছগাছালিতে ভরা বেশ বড় এক দীঘি। তবে পরিচ্ছন্নতার অভাবে মনে হলো অবহেলিত। বের হয়ে পঞ্চগড় এলাম তপ্ত দুপুরে, ভরপেট খেলাম এক রেস্তোরাঁয়। রওনা দিলাম ঠাকুরগাঁও এর উদ্দেশ্যে। আবার আসবো পঞ্চগড় তখন হবে রাত্রী যাপন, এবারের মতো হাটা অতিথি হয়ে নয় কথা দিলাম। এই ভ্রমণটা ছিলো ২০১৯ সালের আজকের দিনে, স্মৃতি হাতড়ে যা মনে ছিলো তাই আটকে রাখলাম।

আমার ভ্রমণে সবসময় বারবার ব্যাবহার করা যায় এমন পানির বোতল ব্যাবহার করি, সিংগেল ইউজ প্লাস্টিকের বোতল ব্যাবহার না করার জন্য। চেষ্টা করি প্লাস্টিকের মোড়কের ব্যাবহার কমিয়ে আনতে, যদি ব্যাবহার করি সেটা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলার আগ পর্যন্ত নিজের ব্যাগের একটা পকেটে সংরক্ষণ করি। প্রকৃতিকে যতোটা সম্ভব কম প্লাস্টিক দিন, তাহলেই ভালো থাকবো আমরা।#উত্তরেরপথেপ্রান্তরে #WayToNorth #TravelResponsibly #DoNotLitter

Leave a Reply