লালাখাল অবাক করা, বিস্ময় জাগানিয়া এক সৌন্দর্যের নাম। দেশের উত্তর পূর্বের ঐতিহ্যবাহী জেলা সিলেট প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। চায়ের দেশ নামেই বহুল প্রচলিত সিলেটের আকর্ষণ পর্যটনপ্রেমীদের কাছে অমোঘ। বছরব্যাপী সিলেটে প্রকৃতিপ্রেমীরা ভীর করে দুটি পাতা একট কুড়ির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার লোভে। সিলেটের সৌন্দর্যের মুকুটে অন্যতম একটি পালক লালাখাল। লালাখাল হলেও এখানে লাল রঙের চিহ্নমাত্র নেই এমনকি এটা কোনো খাল ও নয় ভীনদেশ থেকে বয়ে আসা একটি নদী যার নাম সারি গাঙ। সারি গাঙের পানি এক অন্যরকম রঙ আর আকর্ষণ নিয়েই আকৃষ্ট করে প্রকৃতিপ্রেমীদের।
শীতকালে সিলেটের বেশীরভাগ পানি নির্ভর পর্যটন স্পট গুলো যখন নিষ্প্রাণ,নিস্তেজ। জাফলং, বিছানা কান্দি যখন পানিশূন্য। সংগ্রামপুঞ্জি, হামহাম ঝর্ণা যখন শুষ্ক তখন নিজের বয়ে চলার পথে পথে বিভিন্ন রঙ আর সৌন্দর্য নিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করছে লালাখাল। লালাখাল দেখে প্রথমেই মনের অজান্তে মুখ ফুটে বের হয়ে আসবে, এতো অসম্ভব! কিভাবে সম্ভব একি অঙ্গে এতো রঙ?
কোথাও পানি নীল,কোথাও সবুজ,কোথাও বা স্বচ্ছ টলমলে পানি দেখা যাচ্ছে পানির তলদেশ। পানি এতোটাই স্বচ্ছ যে পানির নিচের সবকিছু পরিস্কারভাবেই চোখে পড়ছে। তলদেশের পাথর বালু কিংবা জলের ভেসে বেড়ানো ছোট মাছ কিংবা শামুক বাদ যাচ্ছেনা কিছুই।
লালাখাল সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা জৈন্তাপুরে অবস্থিত। লালাখাল মূলত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জির ঠিক নিচেই অবস্থিত। চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন সারি গাঙ বা সারি নদী এই পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সারি নদীর পানি নীল এবং সবুজাভ রঙের। জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা প্রবাহমান পানির সাথে খনিজ এবং কাদার পরিবর্তে বালুময় তলদেশের কারনেই পানির রঙ স্বচ্ছ এবং নীল বা সবুজাভ দেখায়। স্থানীয়দের সাথে কথা বলেও এই নীল জলের সারি নদীর নাম কেনো লালাখাল হলো এই বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে লালাখাল জিরো পয়েন্টের পাশেই লালাখাল নামে একটি চা বাগান রয়েছে। লোকমুখে কথিত আছে এই নদী দিয়েই বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন।
কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে সিলেটে যাতায়াতের জন্য সড়ক, রেল এবং আকাশপথে চমৎকার ব্যাবস্থা রয়েছে। সড়কপথে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এসি বা নন এসি বিভিন্ন অপারেটর এর বাস ছেড়ে যায়। ঢাকার মহাখালী থেকে এনা পরিবহনের নন এসি বাস প্রতি ঘন্টা অন্তর ছেড়ে যায়। ভাড়া ৪৭০ টাকা, এছাড়া নিয়মিত ভাবে ছেড়ে যায় এসি বিজনেস ক্লাস বাস, ভাড়া ১২০০ টাকা।
গ্রীনলাইন পরিবহনের বিলাসবহুল এসি সার্ভিস রয়েছে বেশ সুনামের সাথেই সিলেট রুটে চলাচল করে। যাত্রা শুরু করে রাজারবাগ থেকে। এসি বিজনেস ক্লাস ১২০০ টাকা, ইকোনমি ক্লাস ৮০০ টাকা।
সিলেট রুটের মাধ্যমেই সার্ভিস চালু করা লন্ডন এক্সপ্রেস দিচ্ছে বিজনেস ও ইকোনমি ক্লাসের এসি বাসের সুবিধা। জার্মানি থেকে আমদানী করা MAN বাসের এক্সক্লুসিভ যাত্রা শুরু হয় ফকিরাপুল থেকে।
এছাড়া হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ইউনিক সার্ভিস, শ্যামলী পরিবহন, আল মোবারাকা, মামুন এন্টারপ্রাইজ সহ আরো বিভিন্ন বাসের নন এসি সার্ভিস রয়েছে ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ থেকে। দেশের অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহর থেকে সিলেটের সাথে সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে।
সড়কপথে যারা স্বস্তি বোধ করেন না তাদের জন্য নিরাপদ বাহন রেলের প্রতিদিন চারটি আন্তঃনগর ট্রেনের সার্ভিস রয়েছে সিলেটে। ঢাকা থেকে প্রতিদিন সকাল ৬ঃ২০ এ পারাবত এক্সপ্রেস, সকাল ১১ঃ১৫ তে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, বিকাল ০৩ঃ০০ টায় কালনী এক্সপ্রেস ও রাত ০৮ঃ৩০ এ উপবন এক্সপ্রেস ছেড়ে যায় চায়ের দেশ সিলেটের উদ্দেশ্যে। এছাড়াও চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন দুইটি ট্রেন চলাচল করে। সকাল ০৯ঃ০০ টায় পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ও রাত ০৯ঃ৪৫ এ উদয়ন এক্সপ্রেস। ট্রেনে যাতায়াত করতে চাইলে অবশ্যই পূর্বে টিকেট সংগ্রহ করে রাখতে হবে। অনলাইনে Rail Sheba এপস থেকে অথবা cnsbd সাইট থেকেও টিকেট সংগ্রহ করা যাবে।
আকাশ পথে সিলেটে মাত্র ৪৫ মিনিটেই পৌছানো যায়। ঢাকা থেকে বিমান বাংলাদেশ, নভো এয়ার ও ইউ এস বাংলা এয়ারলাইন্স প্রতিদিন ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে প্রতিদিন প্রায় ১০ টি ও সিলেট থেকে প্রায় ১৫ টি ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। ভাড়া ২৫০০ টাকা থেকে ৭৫০০ টাকা। বিমান বাংলাদেশের টিকেটের জন্য ওয়েবসাইট ভিজিট করুন।
নভোএয়ারের রয়েছে ঢাকা ও সিলেট থেকে প্রতিদিন দুইটি করে ফ্লাইট, ভাড়া ২৭০০ টাকা থেকে ৬৬০০ টাকা। টিকেটের জন্য ওয়েবসাইট ভিজিট করুন
ইউ এস বাংলা এয়ারলাইন্স প্রতিদিন ঢাকা ও সিলেট থেকে তিনটি করে ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে। ভাড়া ২৬৯৯ টাকা থেকে ৮০০০ টাকা। টিকেটের জন্য ওয়েবসাইট ভিজিট করুন।
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে সিলেট পৌছে কদমতলী কিংবা সোবহানীঘাট থেকে তামাবিল বা জাফলং গামী বাসে অথবা ধোপাদীঘীর পারের উসমানী উদ্যানের সামনে থেকে সি এন জি কিংবা লেগুনায় করে যেতে হবে সারিঘাট ব্রিজ, ভাড়া নিবে ৩০-৫০ টাকা । কেউ চাইলে প্রাইভেট কার বা যেকোনো গাড়ি রিজার্ভ নিয়েও যেতে পারেন। সারিঘাট ব্রিজের নীচেই সারি সারি নৌকা পাওয়া যাবে লালাখাল যাওয়ার জন্য। নৌকা নিতে হবে বেশ দরদাম করে, ভাড়া ১২০০-১৮০০ টাকা। নৌকা নেয়ার ক্ষেত্রে ঘন্টা হিসেবে না নেওয়াই ভালো। নৌকা ঠিক করার পুর্বে লাইফ জ্যাকেট আছে কিনা নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।
লালাখাল গিয়ে যতটুকু মুগ্ধতা তার চেয়ে বেশী মুগ্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যাওয়ার পথে পথে। প্রায় ঘন্টা খানেকের নদী পথ, ছোট সারি নদী যার শরীরে বইছে নীল সবুজ পানি। যাওয়ার পথে বেশ কয়েকটি বাক রয়েছে, প্রত্যেকটি বাকেই ছড়িয়ে আছে মুগ্ধতা। যেতে যেতে চোখে পড়বে নদীতে কলসী নিয়ে জল তুলতে আসা গৃহস্ত বধুর সাথে কিংবা দুষ্ট ছেলেদের উদ্যাম লাফালাফি করে গোসলের সাথে। এভাবেই মনে হবে লালাখাল যেনো প্রকৃতির নিজ হাতে গড়ে তোলা কোনো মুগ্ধতার আধার। চারপাশের সবুজ গাছপালা দূরের পাহাড়গুলোর ধীরে ধীরে আরো দৃশ্যমান হয়ে যাওয়া পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাথর বোঝাই নৌকা এরকমভাবেই স্বরনীয় হয়ে থাকবে ইট কাঠের শহরকে ছুটি দিয়ে এক দিনের লালাখাল ভ্রমণ।
লালাখালের পাশে নাজিমগড় রিসোর্টে থাকা ও খাওয়ার ব্যাবস্থা রয়েছে তবে বেশ ব্যায়বহুল । এছাড়া থাকার জন্য সিলেট শহর ব্যাতিত ভালো বিকল্প নেই। সারিঘাট বাজারে খাবারের বেশ কিছু হোটেল রয়েছে কম খরচে খাওয়ার জন্য।